সহজাত জীবনের পেছনের গল্প
বছরের এই সময়টাতে আতরকাটি বিলে কচুরিপানার ফাঁকে ফাঁকে বুড়ো-ধেড়ে শিং-মাগুরের গোঁফ দেখা যায়। খলসে-পুটি, মলা-ঢেলারা রোদ পোহায় হাঁটু পানিতে। মোনতার পাঁচ বছরের মেয়েটি চালুনি দিয়ে বিলের সব মাছ ছেঁকে তুলতে চায়, পারে না। মোনতা হেসে বলে, ‘আর মাছ দি কী করস ছেড়ি, থুবি কই; ড্যাগ ভাইরা গ্যাছে’। সূর্য তখনও দক্ষিণ দিক বরাবর আসেনি। মোনতা আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসে। বারে মঙ্গল। শিবপুরের হাঁট। অথচ বিল জুড়ে একটা কাকপক্ষীও নেই। মোনতার বৌয়ের দুইসেরি সিলভারের ডেকচিটি ভরে গেছে একদম। ডেকচির মুখ বন্ধ করা জাল পর্যন্ত পৌঁছেছে গুড়া চিংড়িদের লেজ। একটা গুতোম মাছ সে জালের ছিদ্র দিয়ে বাইরে মুখ বের করায় মোনতা গালি দিয়ে সেটিকে ভেতরে ঢোকায়, ‘ভিত্তে ঢুক হালার পুত’। জাল কাঁধে আর মাছের ডেকচি হাতে হাঁটতে হাঁটতে বেনু মিয়ার লাউয়ের মাচার সামনে আসলে মোনতা প্রস্রাবের চাপ অনুভব করে। মেয়েকে সামনে আগাতে বলে সে আইলের পাশে বসে পড়ে। ‘এহে! মুতোনের আর জায়গা পইলো না, তাও পচ্চিমমুহী বইয়া’। পুবপাড়ার জোলেখা হাসতে হাসতে মাচার ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসে। ‘এই দুপুর বেলা তুই অ্যানে কী করস?’ লুঙ্গিটা আরও খানিক উপরে তুলে মোনতা জিজ্ঞেস করে।
‘চুরি কত্তে আইছিনা, কয়ডা লাউয়ের ডোগা নিতাম আইছি। রান্ধনের মতন কিছু নাই। মাছ তো বালাই পাইছো দেহি’। মূল কথার আগে ও পরে জোলেখা ভূমিকা-উপসংহার যোগ করে। মোনতা ভূমিকা-উপসংহার বোঝে না। তার মতে, জোলেখা দরকারের চেয়ে আড়াইটা কথা বেশি কয়। কথা বেশি-কওয়া মেয়ে মানুষ সরল-সোজা হয়, মোনতা ভাবে—শুকনো কাঠি, লম্বা আর কথা কম-বলা নিরস বউটাকে তালাক দিয়ে যদি জোলেখাকে ঘরে তোলা যেতো। জোলেখার গায়ের রং কালো তেলতেলে, বউয়ের মতো ফর্সা নয়; কিন্তু স্বাস্থ্য ভালো আর সিনেমার নায়িকাদের মতো ঢং জানে, স্টাইল জানে। তার সঙ্গে শুয়ে থাকলে বন্ধু গাজি মিয়ার বিদেশি কম্বলের গন্ধ আর ওম পাওয়া যায়। কিছু দূর হাঁটার পর জোলেখা ডাকে, ‘মোনতা বাই, দিতে দিতে তো মেলা ট্যাহাই হাওলাত দিয়া লাইছো; এ সপ্তায় আর একশো ট্যাহা দ্যাও। দেহি, খ্যাতা কয়ডার কাম শ্যাষ হইলে কিছু ট্যাহা পামু। তহন নে দিয়া দিমু তোমারে। মা’র ওষুদের লাইগাই যতো ঠ্যাহা’। মোনতা থামে। জোলেখার হাত থেকে শাক-লতাপাতার কুলাটা নিয়ে তাতে ডেকচির মাছগুলো ঢালতে শুরু করে। ‘আয় হায়, তোমারে মাছ দিতে ক্যাডায় কইছে!’ জোলেখা তাকিয়ে থাকে, বাধা দেয় না। সাতটা শিং, পাঁচটা কৈ, দু’টো মাগুরের কড়া আর কিছু গুড়া মাছ কুলায় রেখে মোনতা শাক-লতা দিয়ে কুলাটা ঢেকে দেয়। ‘এইডি রাখ্। জিওল মাছগুলা একটা দুইডা কইরা চাচিরে রাইন্ধা দিস্। আমি এমনেও যাইতাম তোগো বাইত্। বালাই অইছে তল্লগে দ্যাহা অইয়া গ্যালো’। জোলেখা কিছু বলে না, কুলাটা তুলে নিয়ে ডানদিকের আইল ধরে পুবপাড়ার দিকে পা বাড়ায়। কিছুদূর গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘রাইতে আইবা মোনতা বাই?’ মোনতা ঘাড় ঘুড়িয়ে জোলেখার দিকে তাকায়, চোখে ইশারা করে সে নিজেও তার বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে। দেলু মুন্সির বিধবা মেয়েটিকে নিয়ে পালিয়ে যাবার পর থেকে নোয়াব আলীর সংসারের গার্জেয়ান মোনতা মিয়া। অসুস্থ-পঙ্গু বউ আর শশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত মেয়ে জোলেখাকে ফেলে নোয়াব আলী কেমন করে যেতে পারলো এ প্রশ্ন সমাজের লোকেদের আবেগপ্রবণ করে তোলে না। বরং অসহায় এই পরিবারে মোনতার অহরহ আসা-যাওয়াটাই সকলের ভাবনার বস্তু। এ নিয়ে সমাজে অনেক রটনা আছে, বদনাম রটানোয় অনেক নিন্দুকের জায়-জরিমানাও হয়েছে। কেউ পেরে ওঠেনি মোনতার সঙ্গে। কেননা, সমাজের মাথা দুবাই-ফেরত গাজী মিয়া মোনতার বাল্য বন্ধু। সপ্তাহে একদিন তার ঘরে ভাত না খেলে গাজী মিয়ার অসুখ করে। এই গাজী মিয়ার চারপাশে এলাকার বেবাক চ্যালাপ্যালারা দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা পাক খায়। সুতরাং মোনতার বিপক্ষে গিয়ে সমাজের সুশীলদের পেরে ওঠার কথা নয়। হাঁটতে হাঁটতে মোনতা জোলেখাকে নিয়ে ভাবে। নোয়াব আলী চাচা মেয়ের বয়েসি একটা মেয়েকে নিয়ে ভেগে যেতে পারলে মোনতা কেন তার দশ-বারো বছরের ছোটো জোলেখাকে সুন্নত মেনে বিয়ে করতে পারবে না? জোলেখার স্বামী খুনের আসামি হয়ে দেড় বছর ধরে জেলে, চূড়ান্ত রায় হয়নি এখনো। ফাঁসি হবে এটা সবাই জানে। পাঁচ’ছ বছরের একটা বাচ্চা মেয়েকে কিনা পাষণ্ডটা পাটক্ষেতে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেছে! বাচ্চাটার উলঙ্গ লাশ আবার ফেলে রেখেছে ক্ষেতের পাশের ভাগাড়ে। উফ্ কী বীভৎস! মোনতা ভাবতে পারে না। তার নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ে। বড়ো রাস্তায় উঠে দুইক্কার দোকান থেকে সে বাকিতে দুই টাকার একটা লিলি বিস্কুটের প্যাকেট কিনে কোমড়ে গুজে রাখে।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে পাড়ার মসজিদে দুলা মিয়ার কণ্ঠ শোনা যায়—‘হাইয়া আলাস সালা, হাইয়া আলাল ফালা’। বাড়িতে প্রবেশ করেই মোনতা বউকে ডাক দেয় মাছগুলো রাখার জন্য। বউ সাড়া দেয় না। কলপারে গিয়ে সে শুকিয়ে যাওয়া কাদা ধুয়ে নেয়। তারপর লুঙ্গিটা ঝাড়া দিয়ে উঠোনে দাঁড়ালে বাংলা ঘর থেকে গাজী মিয়াকে হাসতে হাসতে বের হতে দেখতে পায় সে । ‘আরেহ্ মোনতা মিয়া তোমার লাইগাই বইসা আছিলাম, গেছিলাম ডাকা, বিদেশি সিগারেট পাইয়া গেলাম এক হোটেলে। ভাবলাম তোমার লাইগাও এক প্যাকেট লই। এই লও মিয়া’। গাজী মিয়া ইংরেজি লেবেলযুক্ত একটা সিগারেটের প্যাকেট মোনতার হাতে গুজে দিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায়। মোনতা ডাকে, ‘আর এট্টু বইয়া যাও না মিয়া, রান্ধাবাড়ি হোক’। গাজী মিয়া হাসতে হাসতে চলে যায়, ‘আমুনে পরে, আযান দ্যালাইছে, নামাজে যামু’। একচালা রান্নাঘরের জ্বলন্ত চুলা থেকে আগুন নিয়ে মোনতা একটা সিগারেট ধরায়। রান্না ঘরের সামনে মাটিতে বসে সে সিগারেট টানতে শুরু করে। বিদেশি সিগারেট। কিন্তু দেশিগুলোর সঙ্গে তেমন পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না তার। সিগারেট অর্ধেক পুড়ে গেলে মোনতার বউ বাংলা ঘর থেকে বের হয়, মেয়েকে ডাকে আর মাছের ডেকচিটা কলপারে নিয়ে যায়। বউ অনর্গল বলতে থাকে, ‘কুন সুমায়ত্তে ডাকতাছি গতর দুইতো, প্যাকগুলান হুগায়া খড়ি অইয়া গ্যাছে; ছেড়ি হুনেনি কতা। কই না কই দৌড়াইতাছে ক্যাডায় জানে’। মোনতা বাঁ পায়ের ’পরে ডান পা’টা তুলে দুই হাতের ওপর হেলান দিয়ে বসে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে। তার বউ অনর্গল বকবক করতে থাকে। বিলে-ঝিলে আজকাল আগের মতো মাছ নেই। মানুষ সব ছেঁকে ধরে ফেলেছে। মানুষের প্রতি তার বিস্তর অভিযোগ। ‘মাইনষেরই বা কী দোষ, দ্যাশে কাম-কাইজ আছেনি যে কিছু কইরা খাইবো। থাউকগা, যেডি পাওন গ্যাছে হেডি মাইয়াডায় খাইতে পাল্লেই অইবো’। বউ বলতেই থাকে। কথা বেশি-বলা বউকে মোনতার ভালো লাগে না। তার ইচ্ছে করে অন্যদিনের মতো বউয়ের চুলের মুঠি ধরে উঠোনে আছার মেরে ফেলতে। কিন্তু আলসেমি লাগে। হাতের সিগারেটটি মাটিতে গুজে ধরে সে চোখ বন্ধ করে হাই তোলে। তার হা করা মুখে একটা বিস্কুট ঠেসে দিয়ে পাঁচ বছরের মেয়েটা বলে উঠে, ‘আব্বা, বিলাতি বিস্কুট, গাজী কাকায় দিছে’। মোনতা বিস্কুট চিবায় না, তার আলসেমি লাগে। কোমরের গামছাটা বিছিয়ে সে শুয়ে পড়ে। কালো, মোটা চিরে যাওয়া ঠোঁটে বিস্কুটের গুড়ো লেগে থাকে। একটা মাছি উড়ে এসে সেখানে বসে, হাঁটে; মোনতার ঠোঁটে সুরসুরি লাগে, তার জোলেখার কথা মনে পড়ে।