শহরের পথে-ঘাটে লাল-কালো বাস্তব-স্বপ্ন এবং একটি অসমাপ্ত দৌড়চক্র

শহরের পথে-ঘাটে লাল-কালো বাস্তব-স্বপ্ন এবং একটি অসমাপ্ত দৌড়চক্র


রক্ত দেখে আমরা ভয় পাই। ভয় পেয়ে আমরা দৌড়োতে শুরু করি। পেছনে দুই কিংবা তিন অথবা চার এবং হয়তো পাঁচ জোড়া বুটের ঠপাঠপ শব্দ আমাদের প্রাণপনে দৌড়োতে শক্তি যোগায়। আমরা দৌড়োই—শরীরের ভেতর অসংখ্য শিরা-উপশিরায় উন্মত্ত রক্তের মতন। আমাদের চোখে মধ্যরাতের আবছা অন্ধকারকে লাল মনে হয়। ঈশ্বরদের চোখের আড়াল হওয়ার জন্য শহরের পথে-ঘাটে, ডাস্টবিনে, ময়লার ড্রেনে, ম্যানহোলে কিংবা অন্য যে কোনো কোথাও গায়ে মাখবার এতোটুকুন পরিস্কার কালো আমরা খুঁজে পাই না বলে হতাশ হই এবং আলীয়া মাদ্রাসা পেছনে রেখে বাঁ দিকে মোড় নিতেই একটা ডাবের খোসায় আছাড় খেয়ে পাকা রাস্তায় মুছড়ে পড়ি। ছিলে যাওয়া পায়ের গোড়ালি আর হাঁটু থেকে হয়তো লাল রক্ত গড়িয়ে পড়ে। আমরা লক্ষ করি না। হয়তো আমাদের ‘আঃ’ ‘উঃ’ করবার এক চিমটি সময় নেই; কিংবা হয়তো রক্ত দেখে আমরা ভয় পাই। বুটের শব্দ ক্রমশ জোড়ালো হতে থাকলে আমরা উঠে দাঁড়াই এবং আবার দৌড়োতে শুরু করি। দৌড়োনোর সময় ডাবের খোসাটা সঙ্গে নিতে আমরা ভুলে যাই না।

দৌড়োতে দৌড়োতে আমরা একসময় ঢাকা মেডিকেলের পেছনের গেইটে অর্থাৎ সারি সারি ঘোড়া ও ঘোড়ার গাড়ি যেখানে রাখা হয় সেখানে গিয়ে উপুর হয়ে দাঁড়াই। ফুসফুসে বাতাস সরবরাহ করতে করতে আমরা আবিষ্কার করি—একটা আধমরা ট্রাকের নিচে একজন পুরুষ ও একজন মেয়েলোক জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে উপুর-চিৎ হয়ে, পাশে ঘুমিয়ে একটা লোমখসা সাদাটে কুকুর। তাদের গোঙানির শব্দে আমাদের ভয়ার্ত মস্তিষ্ক হঠাৎ কবি হয়ে ওঠে। আমরা তাই ট্রাকের চাকার ’পরে বাঁ পা’টা তুলে দিয়ে আমাদের কুড়িয়ে পাওয়া ডাবের খোসায় প্রস্রাব করতে শুরু করি। অতঃপর বুটের শব্দ বেশ নিকটতর হলে ট্রাকের নিচে সাদাটে কুকুরটাকে লক্ষ করে আমরা ডাবের খোসাটি সজোরে নিক্ষেপ করি এবং সামনের দিকে আবার ছুটতে থাকি। পেছনে ধাওয়া করে পুরুষ ও নারী কণ্ঠে আমাদের পিতামাতার প্রতি অশ্রাব্য গালিগালাজ, কুকুরের ঘেউঘেউ এবং ঠপাঠপ বুটের শব্দ। আমরা পেছন ফিরে তাকাই না। শহিদ মিনার ডানে রেখে জগন্নাথ হলের পাশ ঘেঁষে আমরা ছুটতে থাকি। পলাশীর মোড়ে চা-খোরদের ভিড়ে হারিয়ে যেতে যেতে পুরুষ-নারীর গোঙানি-গালিগালাজের কথা আমরা ভুলে যাই, এবং ভুলে যাই কুকুরের ঘেউঘেউ, বুটের শব্দ আর রক্তের কথাও। বুয়েটের ভেতর দিয়ে বড়ো লাল বিল্ডিংয়ের দিকে যেতে যেতে কাকের বিষ্ঠাভরা রাস্তায় আমরা বার কয়েক গড়াগড়ি খাই। রাতের দুর্বল কালো এবং ল্যাম্পোস্টের হলুদাভ আলোর সহবাস আমাদের ভালো লাগে। আমরা হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ি। আমাদের অবসন্ন শরীরে প্রচ্ছন্ন নিথরতা ও দুশ্চিন্তাহীনতা ভর করে। কিন্তু আমরা বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে পারি না। কেননা, নৈশপ্রহরীরা আমাদের শুয়ে থাকতে দেয় না। আমরা উঠে পড়ি এবং দৌড়োই।

মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের বিপরীতে বুয়েটের বড়ো গেইটটি রাতের বেলা তালাবদ্ধ থাকে বলে আমাদের দেয়াল টপকাতে হয়। হাঁটুতে, পায়ের গোড়ালিতে প্রাচীন যন্ত্রণারা তখন জেগে ওঠে। আমরা খোড়াতে খোড়াতে কোনো রকমে জয়নাগ রোডের মুখে কমিউনিটি সেন্টারের বড়ো লোহার ডাস্টবিনটায় ঢুকে গা এলিয়ে দিই। খাবারের উচ্ছিষ্টের পচা দুর্গন্ধের ভেতর আমরা ধীরে ধীরে ডুবে যাই। একটা থেতলে যাওয়া মরা বেড়ালের ওপর মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলে পোকা-মাকড়ের সুরসুরি আর মাছির ভনভনানীতে আমাদের ঘুম পায়। আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমোলে আমরা স্বপ্ন দেখি।

স্বপ্ন :

স্থান : ডাস্টবিনের পাশে একটা আধশোয়া ঠেলাগাড়ির নিচের জায়গাটুকু
কাল : রাত্রির মধ্যভাগ অথবা শেষরাতের প্রথমভাগ
পাত্র : আট/দশ বছরের দু’টি বালক

১ম বালক : (একটা রান্না করা মুরগির পরিত্যক্ত হাড় চাটতে চাটতে) হালারপুতেরা হাড্ডিউড্ডি কিছু রাখে নাই এক্কেরে।
২য় বালক : হুর্। গেরামেই ভালা আছিলাম।
১ম বালক : দুন্যাইত সবতেত্তে বেশি খাওন কই আছে জানছ?
২য় বালক : উঁহু। তুই ক তো?
১ম বালক : বেহেস্তত।
২য় বালক : যাঃ বেডা, মরার আগে ঐহানে যাওন যায় নিহি।
১ম বালক : এইডাই তো প্রব্লেম। ভাবতাছি মইরা যামু।
২য় বালক : লাভ নাই। ইছ্ছা কইরা মরলে বেহেস্তত যাওন যায় না—আমার মায় কইছে। কেউ তরে মাইরা ফালাইলে তুই বেহেস্তত যাইতে পারবি। আবার যে মারবো হে যাইবো দুজোখত… হে হে।
১ম বালক : মাথাত এট্টা বুদ্ধি হইছে রে। ধর্, তুই আর আমি দুইজন দুইজনরে একলগে মাইরা ফালাইলাম। তহন কী অইবো?
২য় বালক : কী অইবো?
১ম বালক : তহন আমারে তুই মারছস, আমি বেহেস্তত যামুগা। আবার আমি তরে মারছি, হেল্লাইগা তুই বেহেস্তত যাবিগা! কেমুন?
২য় বালক : হে হে, বুদ্ধিটা কিন্তুক ভালা করছস। তয় মারবি কী দিয়া, ক্যামনে কী?

স্বপ্নের এই পর্যায়ে এসে আমাদের হাসি পায় এবং আমরা হাসবার জন্য হা করলে একটা মাছি আমাদের মুখের ভেতর দিয়ে মস্তিষ্কে ঢুকে যায়। বহু চেষ্টার পর একদলা কফ যখন মুখে আনতে পারি তখন কফের মধ্যে জীবন্ত মাছির অস্তিত্ব টের পেয়ে আমরা আনন্দিত হই। মাছি মারতে যেয়ে আমরা স্বপ্নের কথা ভুলে যাই। স্বপ্নকে আমরা হারিয়ে ফেলি। আমাদের চারপাশে—ডানে-বাঁয়ে, উপরে-নিচে কোথাও যখন স্বপ্নকে আর খুঁজে পাই না তখন ডাস্টবিন থেকে আমরা বেড়িয়ে এসে পাগলের মতো হয়ে যাই। তারপর একসময় ডাস্টবিনের পাশে আধশোয়া ঠেলাগাড়ির নিচে আবিষ্কার করি দু’টি বালককে। বালক নয়, দু’টি বালকের মৃতদেহকে। দু’জনের পেটে দু’টো রড বিদ্ধ করা, রড বেয়ে রক্তের সরু স্রোত নেমে গেছে ময়লার ড্রেনে। আমরা ঘেমে উঠি, আমাদের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। কেননা, রক্ত দেখে আমরা ভয় পাই। ভয় পেয়ে আমরা দৌড়োতে শুরু করি। পেছনে দুই কিংবা তিন অথবা চার এবং হয়তো পাঁচ জোড়া বুটের ঠপাঠপ শব্দ আমাদের প্রাণপনে দৌড়োতে শক্তি যোগায়। আমরা দৌড়োই—শরীরের ভেতর অসংখ্য শিরা-উপশিরায় উন্মত্ত রক্তের মতন। আমাদের চোখে মধ্যরাতের আবছা অন্ধকারকে লাল মনে হয়।