লকডাউন : ঘর ও পরের টানে

লকডাউন : ঘর ও পরের টানে


বেঁচে থাকার নেশার মতো আর কোনো নেশা নেই। বাঁচার জন্য মানুষ মরে যায়, মরার জন্য বাঁচে না। ঘরে থাকে মানুষ বাঁচার জন্য। বাইরেও যায় বাঁচার জন্যই। কিন্তু কোন্ সময়ে কোনটা যে বেঁচে থাকার প্রকৃত উপায়, তা মানুষ সব সময় নিরূপণ করে উঠতে পারে না। ফলে কখনও কখনও এমন এমন সব পরিস্থিতির সম্মুখীন মানুষকে হতে হয় যা মৃত্যুর চেয়েও বেদনাদায়ক, যন্ত্রণাকর। আমরা আজ এমনই উভয়-সংকটের সামনে দাঁড়িয়ে। ঘরে বন্দি থাকলে করোনা থেকে বাঁচার সুযোগ পাই। কিন্তু খিদেয় মরি। বাইরে গেলে খিদেটা হয়তো মেটে, কিন্তু করোনার কবলে পড়ি। তাহলে কোন পথে গেলে এই মহামারীর সময়ে বেঁচে থাকা সম্ভব?

বহু মানুষের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ঘরে থেকেও কষ্টেশিষ্টে অন্তত কয়েক সপ্তাহ বেঁচে থাকার সুযোগ রয়েছে। কাজেই তারা এই উভয়-সংকটের মধ্যে নেই। কিন্তু বাইরে না গেলে যাদের ঘর টেকে না, তাদের কী হবে? আশার কথা হলো, তাদের জন্যও সরকার, প্রশাসন এবং সমাজের সচ্ছল মানুষেরা যার যার অবস্থান থেকে, যার যার দায়িত্ববোধ থেকে ভূমিকা পালন করছেন। তাই বলা যায়, সকলের ঘরে থাকাটা নিশ্চিত করা যাচ্ছে। কিন্তু তবুও আমরা বহু মানুষ ঘরে থাকার সমুদয় সুযোগ লাভ করেও ঘরে থাকি না। বাইরের টানে প্রাণটা আমাদের কেমন কেমন করে।

এর পেছনে একটা মনস্তাত্ত্বিক কারণ রয়েছে। পরের সঙ্গে সম্পর্ক আমাদের যতোটা মাখামাখির, ঘরের সঙ্গে ততোটা নয়। বিপদ জেনেও তাই ঘরে থেকে আমরা বিরক্ত হই, বাইরের টানে বেরিয়ে যাই। সকলের ক্ষেত্রে যদিও এমনটা বলা প্রযোজ্য নয়। তবে এদেশের অধিকাংশ পরিবারেই এ চিত্র লক্ষণীয়। বাইরে আমরা যতোটা হাসি-আনন্দ, প্রাণবন্ততার সঙ্গে সময় যাপন করি, ঘরে ততোটা পারি না। ঘরের সঙ্গে যেন সম্পর্ক আমাদের নিছক দায়িত্বের নিছক কর্তব্যের, স্বার্থহীন বন্ধুত্বের নয়। তাই ঘরে আমরা হাসতে পারি না, হাসলেও মুখটা বাইরে হাসার মতো চওড়া হয় না, হাসিতে উচ্ছল শব্দ হয় না, হাসতে হাসতে একে অপরের ওপর গড়িয়ে পড়া হয় না। সর্বত্রই একটা সংকোচ, আঁটসাঁট অফিসিয়াল এনভায়রনমেন্ট। সব কিছু পরিমাপে বাঁধা। এজন্য ঘরে থাকাটা উপভোগের না হয়ে হয়ে ওঠে বিরক্তির।

সামাজিক বন্ধন আমাদের দৃশ্যত যতোটা দৃঢ়, পারিবারিক বন্ধন ততোটা নয়। ভেতরে ভেতরে মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালোবাসার কমতি পরিবারে নেই। কিন্তু তা একেবারেই গোপন, প্রকাশ পায় না। অথচ ঘর হোক পর হোক, সম্পর্কে সুখ পাওয়ার জন্য, সম্পর্ককে উপভোগ্য করে তোলার জন্য এ সব গোপন অনুভূতির প্রকাশ করাটা জরুরি। পিতামাতা-সন্তান এবং বয়োজ্যেষ্ঠ যারা রয়েছেন পরিবারে, সকলের মধ্যেই পরস্পর স্নেহ-ভালোবাসার দৃশ্যমান লেনদেন প্রয়োজন। অন্তত এ মহামারী-সংকটে, অবসর-অবকাশে তা বিশেষভাবে প্রয়োজন। রান্নাঘরে রান্নায় ব্যস্ত ঘরণী। কর্তা গিয়ে যদি বলেন, “আধোয়া জামাকাপড়গুলো দাও, তুমি রান্না করতে করতে আমি সব ধুয়ে ফেলি”। অমর্যাদা হবে কি? দুপুরে খাওয়ার পর ছেলের বউ যদি পান-সুপারি সাজাতে গিয়ে শশুর-শাশুড়ির নিকট তাঁদের বিয়ের গল্প শুনতে চায়, বেয়াদবি হবে কি? অথবা পড়ার ঘর থেকে সন্তানদের ডেকে এনে বাবা-মা যদি বলেন, ” চল্ সবাই লুডু খেলি”; ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে কি?

সীমাহীন অবসর ভর করেছে আমাদের জীবনে। ঘরে হয়তো অসুস্থ, বয়স্ক মৃত্যুভয়ে ভয়ার্ত পিতামাতা। কাছে বসে গল্প করার, আরও কিছুকাল বেঁচে থাকার জন্য আশ্বস্ত করার সময় কিংবা রুচি আমাদের হয় না। কৈশোর-যৌবনের নানা ভালোলাগা-মন্দলাগা, মনের সব গোপন ইচ্ছে-অনিচ্ছের গল্পগুলো পরিবারের সকলকে মনখুলে শোনানোর কিংবা শোনার মতো মানসিকতা আমাদের কাজ করে না। দুরন্ত শিশুদের সঙ্গে শৈশব যাপনের সময়ও আমাদের আজ নেই। বাইরের জগতের প্রতি কেবল অকারণ টান। মাটির গভীরে শেকড়ে-মূলে শক্ত না হয়ে শুধু বাইরে হাজার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করলেই পরিবার নামক সংসারবৃক্ষটির টিকে থাকা সম্ভব নয়—এ সত্য আমরা উপলব্ধি করতে পারি না কেউ।

কিন্তু অবহেলার সুযোগ নেই আর। ঘরে ভালো লাগুক আর না লাগুক, বাঁচতে হলে ঘরেই আমাদের থাকতে হবে। মনে হচ্ছে, বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া কিংবা হাঁচি-কাশির শিষ্টাচার মেনে চলার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ এখন ঘরে অবস্থান করা; যে কোনো মূল্যেই হোক। এক জনের অবহেলা, অসচেতনতা, হেয়ালিপনা পুরো পরিবার, সমাজ এমন কি গোটা রাষ্ট্রের ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠতে পারে এই সময়ে। তাই ঘরে থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রয়োজন ঘরের মানুষগুলোর সঙ্গে ভালো সময় কাটানো। ভয়-আতংক দূর করার জন্য, একটা নিরাপদ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখানোর জন্য এবং বেঁচে থাকতে আশাবাদী হয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন পরিবাবের মধ্যে দিলখোলা সহমর্মিতা, অবাধ আনন্দ আর মানসিক সহযোগিতার অনুশীলন।