বিশ নম্বর পাণ্ডুলিপি
আমরা এখন হাঁটছি। একটা চেনা গন্তব্যে অচেনা পথ ধ’রে হাঁটছি। পথিক আমরা তিনজন। আমি—একজন বেকার যুবক, স্বল্প-মাইনের গৃহ-শিক্ষক; ডান পাশে আমার হাত ধ’রে হাঁটছে সাত বছরের একটি মেয়ে, আমার ছাত্রী। বাঁ পাশে তার মা।
আমাদের চেনা পথের এই নিরুদ্দেশ যাত্রায় আবেগঘন কিছু কথা অন্তত হ’তে পারতো; না-হয় কেবল দীর্ঘ নিঃশ্বাসের গুমোট কিছু শব্দের আদান-প্রদান; অথবা একে অপরের হাতের স্পর্শে একটা উত্তরহীন প্রশ্নের আভাস দেয়া-নেয়া। কিছুই হয়নি, কিছুই হচ্ছে না। হবে না হয়তো।
গল্পটা যখন শুরু তখন ডিসেম্বরের প্রায় শেষ। দু’মাসের মাইনে বাকি। আমার একলার সংসারের জন্য টাকাটা নেহায়েৎ কম নয়, পুরো এক হাজার। টাকাটা আনতেই গিয়েছিলাম নীতুদের বাসায়। নীতুর বাবা—একজন প্রচারবিমুখ কবি, তখন তিনি তাঁর বিশ নম্বর কাব্যের পাণ্ডুলিপি লিখতে শুরু করেছেন। খাজে দেওয়ান প্রথম লেনের একটা পুরনো ভাঙা বাড়িতে ভাড়া থাকতেন তাঁরা। দু’পাতা লিখে-প’ড়ে কতোই বা আয় কবির।
পড়বার ঘরে আমার হাতে চায়ের কাপটা দিয়েই নীতুর মা বেড়িয়ে গেলো। মন ভালো ছিলো না, চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে বারান্দায় আসতেই শুনতে পেলাম নীতুর বাবার কণ্ঠ, “বললাম যে আমার হাতে এখন বিষ খাওয়ার মতো দুই টাকার একটা কয়েনও নাই, খালি খালি প্যাচালের কোনো মানে হয়?”
ভেবেছিলাম জবাবে নীতুর মা বেশ কঠোরভাবেই একটা কিছু শুনিয়ে দেবে, দেয়নি। কেবল মেঝের উপর একটা কয়েন পড়বার শব্দ পেলাম। আমি বড়ো দাঁড়াইনি। চ’লে এলাম। তার পরে কী ঘটেছিলো আমি দেখিনি, লোকের মুখে শুনেছি।
আমরা এখন হাঁটছি। একটা চেনা গন্তব্যে অচেনা পথ ধ’রে হাঁটছি। আমরা শুধুই তিনজন। সদ্য একটা হত্যা মামলা থেকে খালাস পাওয়া দু’জন নর-নারী। আর একটা অবোধ শিশু।
ভদ্রলোক ম’রে গিয়েও আমাদের বাঁচিয়ে গেছেন। কবির সহস্তে লেখা ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেহ দায়ী নহে’ চিরকুটখানা তাঁর এই হত্যাকাণ্ডকে আত্মহত্যা ব’লে প্রমাণ ক’রে আমাদের বাঁচিয়েছে এবং পথে নামিয়েছে এবং আমরা এখনো হাঁটছি। একটা চেনা গন্তব্যে অচেনা পথ ধ’রে হাঁটছি। পথিক আমরা তিনজন।