পায়ে চলা পথিক
যখন ভোরের হিমহিম শীতল হাওয়ায় নির্জন- পরিস্কার- পরিচ্ছন্ন পাকা রাস্তার উপর একটি- দু’টি শুকনো ঝরাপাতা মৃদু বাতাসের তোরে কেমন উড়ে উড়ে যায়, আর সদ্য ঘুম থেকে জেগে ওঠা কালো কাকেদের দল নীরবতার কঠিন কাঁচের আস্তরণ ভেঙে দিয়ে থমকে যাওয়া শহরকে গতিময় করে তোলে আবার; তখন হলুদ শাড়ীটার আঁচলখানা আরো দু’একবার টেনে ঠিকঠাক করে অপেক্ষমান বালকের চোখের দিকে তাকিয়ে বালিকা তার রাঙা ঠোঁটের মাঝখানে সরু জিভখানা বের করে ভেংচি কাটে। বলে— ‘এহ্ ঢং কতো’!
ফুলার রোডের পাশে বড়ো কড়ই গাছটার নীচে যেখানে বালক- বালিকা পাশাপাশি বসে কথা কয় সেখানে, ছোট্ট দু’টি হাত, কচি কচি আঙুল তার; এক ঝুড়ি গোলাপ- গাঁদা আর রজনীগন্ধা তুলে ধরে যুগলের সামনে। মুখে নয়; চোখ দিয়ে জিজ্ঞেস করে— ‘কোনটা চাই’? বালক আঙুল দিয়ে দ্যাখায়— ওটা। বালিকা অভিমান করে। নাহ্, ওটা না; এটা। তারপর হঠাৎ নিষ্পাপ একখানি মুখে টোলপড়া ফোঁকলা হাসিতে স্তব্ধ হয়ে ওঠে চারপাশ। আচমকা বাতাসে বৃষ্টির মতো ঝরতে শুরু করে অসংখ্য শুকনো পাতা। চোখের উপর থেকে উড়ন্ত চুল গুলো সরিয়ে বালিকা হেসে ফেলে। বলে—‘যাহ্, দুটোই নিলেম’। আরো একবার চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে সেই ফোঁকলা হাসির চাপা শব্দে। সে হাসি কেউ দ্যাখে না, সে হাসির শব্দ কেউ শোনে না। যে দ্যাখে, যে শোনে, সে কখনো ফুল কেনে না। কেননা ঐ গাছটির নীচে কখনো বসতে হয় না তাকে। সে বসেনি কোনোদিন। কখনো বসে না। সে কেবল পথের এক পাশ দিয়ে একাকী হেঁটে চলে।
ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত সব মানুষ ছুটে চলে আপন গন্তব্যে। অনেকে হিমু হয়। যুক্তি আর অনুভূতির প্রকট মায়াজালে কতো রূপাকেই না আটকে রাখে তারা। কেবল কেউ কেউ ধূলোপায়ে হাঁটে। বাঁ পায়ের ছেঁড়া স্যান্ডেলটার প্রতি দৃষ্টি এড়ায় না তাদের। তবুও হাঁটে। গন্তব্যহীন পথে কেবল হেঁটেই চলে। থামে না। কেননা, কেউ কখনো পিছু ডাকে না তাদের।
তারপর সন্ধ্যেবেলা যখন কালো কাকেদের দল আশা আর হতাশার প্রবল দ্বন্দ্বে খেই হারিয়ে বেঁচে থাকবার অর্থ কেবল ডাস্টবিনের পঁচা-বাসী উচ্ছিষ্টকেই ধরে নেয়, আর ডানার ঝাপটায় আকাশ- বাতাস ভারী করে তোলে; এবং যখন ল্যাম্পোস্টের হলুদাভ আলোয় সেই কড়ই গাছটার নীচে বসে বালিকা বালকের মাথার উপর বাদামের খোঁসা ছড়িয়ে দেয় এবং অতঃপর সেই ছোট্ট নিষ্পাপ কচি মুখখানা আবার তিনটি ফুল নিয়ে তাদের সামনে উপস্থিত হয়, তখন পায়ে চলা পথিক সন্ধ্যার মৃদু অন্ধকারে নির্জন পথে একাকী দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলে— ‘আজ আমিও একটা ফুল নিবো’।
কচি মুখে টোলপড়া ফোঁকলা হাসি আবার পথিকের সমস্ত হৃদয় শীতল করে দেয়। বালক- বালিকা হাত ধরে চলে এবং একসময় অন্ধকারে আড়াল হয়ে যায়। পায়ে চলা পথিক ডেকে ওঠে— ‘ও খুকি, এদিকে এসো’। খানিক ভয়ে খানিক আনন্দে ছোট্ট খুকি সামনে এসে দাঁড়ায়। পথিক জিজ্ঞেস করে— ‘আচ্ছা, একটা গোলাপ কতো করে’? হঠাৎ গগণবিদারি মূক আনন্দ চিৎকারে আকাশ- মাটি কেঁপে ওঠে যেন। শূন্য ঝুড়িটা পথিকের সামনে তুলে ধরে এক দৌড়ে খুকি আঁধারের সঙ্গে মিলিয়ে যায়। কিন্তু সে হাসির তীব্র বিকট- বিভৎস চাপা শব্দ যেন আকাশে- বাতাসে ধ্বনিত হতে থাকে বজ্রের মতো। অথচ সে হাসি কেউ দ্যাখে না, সে হাসির শব্দ কেউ শোনে না। যে দ্যাখে, যে শোনে, সে কখনো ফুল কেনে না। কেননা ঐ গাছটির নীচে কখনো বসতে হয় না তাকে। সে বসেনি কোনোদিন। কখনো বসে না। সে কেবল পথের এক পাশ দিয়ে একাকী হেঁটে চলে।