নিভৃতের কথা

নিভৃতের কথা


অনেক বেশি নৈকট্য কাছের মানুষদের যতোটা দূরে সরিয়ে রাখে, খানিকটা দূরত্ব বোধ করি সে দূরত্বকে অনেকটা কমিয়ে আনে কখনো কখনো। কাছের ও দূরের মানুষদের এই কাছে-দূরের যোগ-বিয়োগ করবার ফাঁকে আমি-তুমি না হয় কাছে-দূরের মধ্যেখানে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ মনের কথা কই চলো।

কাছে থাকার অর্থ যদি মনে করো গায়ের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে লেকের পাড়ে বসে সময় পার করা তাহলে তোমাদের সঙ্গে না হয় আজ এটুকুই থাক। আর ভিন্ন কিছু যদি ভাবো, যদি মনে করো একটুখানি বললে একটুখানি শুনলে দোষের কী— তবে বসো না কিছুক্ষণ। চায়ের কাপের ঐ ‘চুরুৎ চুরুৎ’ শব্দটা বেশ ভালো লাগে জানো তো। আচ্ছা যা হোক, আমরা বরং কথায় ফিরে যাই।

কাছে থাকতে থাকতে বুঝলে, বড্ড দূরে সরে গিয়েছিলুম। এবার দূরে সরে গিয়ে আবার কাছে চলে এলুম। দিবারাত্রি চোখের সামনে যা কিছু বর্তমান, দু’কানে যা নিত্য বাজে; তা সব ক্রমশ পরিচিত হতে হতে একেবারে কেমন ‘নেই’ হয়ে যায় কখনো কখনো এবং মনে হয় যেন চোখের সামনে সব শূন্য; কিচ্ছুটি নেই। কেউ নেই কোথাও। তুমি-আমি, আমরা এতো কাছের, এতো কাছে; তারপরেও সব কিছুতে কেমন ‘না থাকা না থাকা’ গন্ধ ভেসে বেড়ায়। সবশেষে যা থাকে তা সেই ‘না থাকা’। না থাকা কিছু একটা। যা এক সময় ছিলো, আর নেই। কিংবা যা নেই, থাকবে এক সময়। সেই না থাকা কিছু একটা যখন আমার সমস্ত ভাবনা জুড়ে, কল্পনার পরতে-পরতে একেবারে সেঁটে গেলো, প্রতিটা নিঃশ্বাসের সঙ্গে দেহের প্রত্যেকটা রক্তবিন্দুর সঙ্গে আষ্টে-পিষ্টে-লেপ্টে গেলো একদম; তখন বুঝতে পারলুম— বস্তুজগৎ আর ভাবনালোকের মধ্যিখানে যুক্তি-তর্ক আর দর্শনের যে সুউচ্চ সুকঠিন প্রাচীর, তা টপকানোর সময় এসে গেছে।

তারপর আর কী— ভাবনারাজ্যের নিভৃতের লোক শেষমেশ ইট-কাঠ-পাথর, ধূলো-বালির এই জগৎটাকে পশ্চাতে রেখে দিলো গা-ঢাকা। কিন্তু শেষবধি পারলে কই। সেই তো ফিরে আসতে হলো কাছে-দূরের সব হিসেব-নিকেশে গোল পাকিয়ে। না পেলে না থাকা কিছু একটার খোঁজ, না পারলে থাকা সব কিছু থেকে দূরে সরে থাকতে। তোমাদের সামনে যে আমি, তার দৃষ্টি বরাবর যদি তোমরা হাঁটতে শুরু করতে; (যদি এমনটা সম্ভব হতো) একদিন হয়তো পুরো পৃথিবী ঘুরে এসে আমার পেছন দিক থেকে তোমরা ঠিক এই জায়গাটিতে ঠিক এই আমাকেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে। অথচ আমার দৃষ্টি বরাবর হাঁটতে শুরু করবার পর পুরো পৃথিবীর উল্টো দিকটা ঘুরে আসবার পরেও আমি ঠিক এই জায়গাটিতে ঠিক এই আমাকে কখনোই দেখতে পেতাম না, অর্থাৎ পশ্চাতে দাঁড়িয়ে স্বরূপ-দর্শন কখনো হতো না আমার— সে খবর কেউ দিলে না তোমরা। তুমিও না। আপনার খোঁজে আপনাকে ছেড়ে যতোই সম্মুখে ছুটতাম, দিগন্তের সীমা ততোই অন্তহীন হয়ে উঠতো— ভাবতেই নিজেকে কেমন জ্ঞানহীন বোধ হয় বলো তো?

এই যাহ্! জুড়িয়ে গেলো চা টা। গেলোই বা। কে বা কার জন্যে বসে থাকে। তুমিও যেমন যাচ্ছো। ঐ তো ওরাও। শেষমেশ থাকলে কে?— আমি। না থাকার দলেও আমি। আসলে সব কিছু সব কিছুর জায়গাতেই থাকে। কেবল তুমি-আমিই কেমন সরে সরে যাই। আমরা সবাই ছুটি। কেউ পরকে ধরবার জন্যে অপরের পেছনে ছোটে; কেউ নিজের পেছনে ছোটে নিজেকে ধরবার জন্যে। সবাই ছুটোছুটির উপর। জগৎটাই যখন ছুটোছুটির তখন কাছে-দূরের হিসেব কষেই বা কী হবে বলো তো? তোমরা বরং ছুটে এসো কিছুক্ষণ। আমিও আর দু’এক কাপ খাই। জানো তো, চায়ের কাপের ঐ ‘চুরুৎ চুরুৎ’ শব্দটা বেশ ভালো লাগে আমার।