নব-জন্ম
সমস্ত রাত্রি তুমুল বর্ষণের পর সকাল বেলার প্রথম সূর্যের কিরণখানি যখন অন্য দিনের অন্য সকালের চেয়ে খানিকটা বেশি উজ্জ্বল-তীক্ষ্ণ অথচ কোমল হইয়া খোলা জানলা দিয়া খোকনের মুখের উপর পড়িলো, তখন কাঁথাটা আরেকটু টানিয়া লইয়া কোল-বালিশটাকে আরো খানিকটা আপন করিয়া খোকন পাশ ফিরিয়া শুইলো। আজিও নিত্য দিনের মতন একখানা রাঙা হাত একগাছি কাঁচের চুড়ির রিনিঝিনি সুর-ছন্দে তাহার মুখে, কপালে আদর করিয়া দিলো; চুলে বিলি কাটিয়া দিলো; সুরসুরি দিয়া গুতোগুতি করিয়া তাহাকে ক্ষ্যাপাইয়া তুলিবার সমস্ত আয়োজন শেষ করিলো। আজিও প্রতিদিনকার মতন সেই সুমিষ্ট কণ্ঠে পরম অনুনয়ের সুরে খোকনের কান দুইটি মোহিত হইয়া গেলো :
‘একি খোকন? কত্তো সকাল হলো যে। ইস্কুলে যেতে হবে তো। ওঠো না এবার।’
খোকন উঠিলো না। কাঁথায় মুখ লুকাইয়া আরো খানিকটা গুটিসুটি হইয়া তবে পাশ ফিরিলো। বধূ ‘ওহ্ আচ্ছা’ বলিয়া একটুখানি মুচকি হাসিলো। তারপর এই সাত বৎসর বয়সী অবুঝ নিষ্পাপ বালকের স্কুলে না-যাইবার সকল ফন্দি-ফাঁকিবাজি প্রকৃতির নিকট প্রকাশ করিয়া দিতে যেই বিছানার উপর ঝুকিয়া পড়িলো, খোকন অকস্মাৎ তাহার শাড়ির আঁচলখানা টানিয়া লইয়া বালিশে মুখ গুজিলো; আর চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলো, ‘আজ ইস্কুলে যাইবো না মা’।
মুহূর্তে পৃথিবীর রূপ বদলাইয়া গেলো; রঙ বদলাইয়া গেলো। বসন্ত-প্রভাতের মৃদু উন্মত্ত বাতাস আমের নূতন মুকুলের গন্ধ ভাসাইয়া আনিতে লাগিলো। একটা হলুদ প্রজাপতি জানলার ভিতর দিয়া আসি আসি করিয়াও নাচিতে নাচিতে চলিয়া গেলো।
বধূর সমগ্র শরীর শীতল হইয়া আসিতেছিল। সে কোনো কথা কহিতে পরিলো না, কেবল বিহ্বলের ন্যায় চাহিয়া রহিলো। এই দুই-আড়াই মাসের মধ্যে খোকন প্রথমবারের মতন আজ তাহাকে ‘মা’ বলিয়া ডাকিয়াছে। জগতের সমস্ত ভাষা সমস্ত ধ্বনি-শব্দ যেন আজ সহসা নিথর হইয়া গিয়াছে। সে কিছু ভাবিতে পারিলো না— একটানে খোকনকে বুকে লইয়া দ্রুতবেগে পাশের ঘরে চলিয়া গেলো এবং কাঁঠাল কাঠের বড়ো আলমারিটায়, যেটিতে রূপার ফ্রেমে বাঁধাই করা একখানি সাদাকালো ছবি, যেটিকে প্রত্যহ নিয়ম করিয়া বড়ো যত্নে বড়ো আদরে ঝারিয়া মুছিয়া সে তাজা গাদাফুলের মালা দিয়া সাজাইয়া দেয়— সেই ছবিখানার সামনে গিয়া দাঁড়াইলো।
খোকন নূতন উষ্ণতার পরশে মায়ের গলা জড়াইয়া কাঁধে মাথা রাখিলো। মা কেবল মূক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলো। পৃথিবী আজ তাহার নিকট নূতন-মতো ঠেকিতেছে। বহু কষ্টে দু’চারিটি শব্দ জোগাড় করিয়া ক্ষণকাল পরে কোনোমতে সে মুখে উচ্চারণ করিলো, ‘আজ তোমায় ইস্কুলে যাইতে হবে না বাবা’; আর সজল নয়নে সেই ছবিখানাকে উদ্দেশ্য করিয়া মনে মনে কহিলো, ‘দোয়া করিও বোন, আমি যেন তুমি হইতে পারি’।