দু’চোখ দিয়ে দেখা
পথের দু’ধারে কচি পাতা রাতের অন্ধকারে ল্যাম্পোস্টের হলুদাভ আলোয় যখন খানিকটা সবুজ-কালো হয়ে ওঠে এবং নির্জন পিচ-ঢালা পথে বর্ষণ-পূর্ব দমকা বাতাসে ছেঁড়া কাগজ, বাদামের ঠোঙা, শুকনো ঝরাপাতা এটা-সেটা উড়ে গিয়ে পথকে করে দেয় নূতন দম্পতির গুছানো শয্যার মতন শীতল-শান্ত-সুন্দর; তখন কারো কারো পায়ের শব্দে ফুটপাতে পড়ে থাকা শীর্ণ দেহক’টা এপাশ-ওপাশ করে আরো কয়েকবার। কখনো কড়ইয়ের ডালে দেখা না যাওয়া কোন্ এক পাখি ডানার ঝাপটায় শুকনো পাতা ঝরিয়ে দেয় হঠাৎ। হলদে আলোয় পাতা গুলোকে ঠিক যেন আতশবাজির জ্বলন্ত ফুলকির মতো মনে হয়। গলির মোড়ে চারপাশে দেয়াল ওঠানো বড়ো বাড়িটায় যেখানে রোজ বিয়ের মঞ্চ বসে, সন্ধ্যায় নানা রঙের আলোয় আতশবাজির ফুলকিগুলো কেমন করেই না আকাশে ছড়িয়ে গিয়ে শূন্যে মিলিয়ে যায়। দেখতে কী না লাগে! চোখের তৃষ্ণা মেটাতে কতো পথিকই না চারপাশে ভিড় জমায় তখন। অন্দরে প্রবেশের অধিকার সকলের থাকে না যদিও; উপভোগ কারোর চেয়ে কেউ কম করে না। মোগলাই রান্নার ঝাঁঝালো সুগন্ধি আর রাস্তার পাশে ডাস্টবিনের পচা দুর্গন্ধের মধ্যে তফাৎটা কতো— বার কয়েক তাড়া খেয়ে ল্যাজ নাড়াতে থাকা নেড়ি কুকুরটার কাছে হয়তো তা অধিকতর স্পষ্ট, যতোটা না অস্পষ্ট এবং রহস্যময় সে সকল চক্ষুতৃষ্ণায় কাতর পথিকদের কাছে।
আলোর কতো রং, কতো রঙের আলো জগৎ জুড়ে! সে আলোর ঝিলিক লাগে চোখে, মনে, পথের ধূলোয় আর ডাস্টবিনের পাশে পুরনো টায়ারের ভেতর মরে পচে শুকিয়ে যাওয়া বেড়ালছানাটির উড়ন্ত শুভ্র পশমের মাঝে।
ফেরবার পথে কারো কারো মনে পড়ে রবি ঠাকুরের “বাঁশি’র” দু’এক চরণ—
“এ গলিটা ঘোর মিছে
দুর্বিষহ মাতালের প্রলাপের মতো”।
অথবা
“ধলেশ্বরী-নদীতীরে পিসিদের গ্রাম—
তাঁর দেওরের মেয়ে,
অভাগার সাথে তার বিবাহের ছিল ঠিকঠাক।
লগ্ন শুভ, নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেল—
সেই লগ্নে এসেছি পালিয়ে।
মেয়েটা তো রক্ষে পেলে,”
তলা ক্ষয়ে যাওয়া স্যান্ডেলের সঙ্গে পায়ের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা আলপিনগুলো দায়িত্বের চরম সীমা ছাড়িয়ে পথকে যখন একফোঁটা দু’ফোঁটা রক্তে রাঙিয়ে দেয়, তখনো হয়তো কারো কারো চোখের তৃষ্ণা দূর হয় না একতিল। তবে শহরের পথে-ঘাটে গোপনে বেড়ে ওঠা নিশাচর ইঁদুরের দল রক্তের লাল লেগে থাকা পথের ধূলো চেটে পেটের তৃষ্ণা মিটিয়ে নেয় খুব সহজেই।
চারতলায় উঠতে ছয় ধাপ সিঁড়ি। নিশ্চলপ্রায় পদযুগলের উপর ভর দিয়ে অন্ধকারে সিঁড়ি অতিক্রমের এই স্বাভাবিক অথচ দুঃসাহসিক অভিযানটি মাউন্ট এভারেস্ট জয়ের চেয়ে কম কীসে! নানা আলোয় আলোকিত শহরের মাঝে জরাজীর্ণ পাকা বাড়ির ছোট্ট একটা ঘরে অকস্মাৎ দিয়াশলাইয়ের কয়েক খোঁচায় জ্বলে ওঠা মোমবাতির ভয়ার্ত আলোকরশ্মি পথিকের চোখে জাগায় নূতন আলোর তৃষ্ণা। জানলার পর্দাটা খানিক সরিয়ে অর্ধেক গ্লাস গরম পানিতে দু’কুচি আদা মিশিয়ে গভীর শ্রান্তির নিঃশ্বাসের পর ছোট্ট করে একটা চুমুক দিয়েই পথিক তখন ভাবে— এ শহর বড়ো অদ্ভুত! এ জগৎ এক আজব জায়গা!