করোনার দিনে যা কিছু মনে পড়ে
এমনই ইস্কুল ছুটির মৌসুমে সকাল-দুপুর-সন্ধ্যে যখনই মর্জি হইত খেলিতে বসিয়া যাইতাম। একটা পুরাতন ট্রলি ব্যাগ বোঝাই খেলিবার জিনিসপত্তর-যন্ত্রপাতি ছিল। তাহাতে ছোট মাটির হাঁড়ি-পাতিল হইতে শুরু করিয়া টেলিভিশন খুলিয়া জোড়া লাগাইবার স্ক্রু ড্রাইভার পর্যন্ত স্থান পাইয়াছিল। মোটকথা মিছামিছির সংসার-খেলাঘর পাতিবার জন্য অতখানি বয়সে যাহা যাহা দরকার পড়িতে পারে তাহার সকল কিছুই ছিল আমার সংগ্রহে। খেলিতামও ইচ্ছা মত মন ভরিয়া। আমাদের মাটির ঘরের পাশেই ছিল মাঝারি আকারের একটা পেয়ারা গাছ। তাহার নিচে বসিয়া খেলিতাম। আশপাশের ছেলেমেয়েরা মিলিয়া আমরা কোনো কোনো দিন দশ-বারো জনও হইয়া যাইতাম। তখন চেঁচামেচি বেশি হইয়া গেলে মায়ের বকা খাইতে হইতে পারে—এই ভাবিয়া খেলিবার জিনিসপত্তর টানিয়া লইয়া যাইতাম বাড়ি হইতে দুই উঠান দূরে মেহগনি বাগানে। খেলিবার সব কিছুই যেহেতু আমার, ফলে কর্তৃত্বটাও আমারই থাকিত। এই ব্যাপারটাকে আমি বেশ উপভোগ করিতাম। কাহারও কলাবাগান হইতে পরিত্যক্ত কলার থোড়-মোচা কুড়াইয়া আনা হইয়াছে। এখন ইহাকে খাসির মাংস হিসাবে রান্না করা হইবে নাকি গরুর মাংস হিসাবে, তাহা নির্ধারণ করিতে গিয়া মেয়েদের মধ্যে চুলাচুলি বাধিয়া গেলে মিমাংসা করিতে হইত আমাকে। আমি হয়ত বলিতাম, ইহা খাসির মাংসও নয়, গরুর মাংসও নয়—কবুতরের মাংস। সকলেই ‘ঠিক ঠিক’ বলিয়া মানিয়া লইত। ছেলেদের মধ্যে বাজার করিতে কে উত্তরপাড়ার জঙ্গলে যাইবে আর কলাপাতার ঘর বানাইবার জন্য কে বাঁশের কঞ্চি কাটিতে যাইবে তাহা নিয়াও বাধিত গোল। সেইখানেও আমাকেই মিটমাট করিতে হইত। এইভাবে কত হাসি কত আনন্দে কাটিয়া যাইত একেকটা ইস্কুল ছুটির দিন৷ ভুলিয়াই যাইতাম জগতে এই মিছামিছির ঘরকন্না খেলা ছাড়া আরও বহু কিছু করিবার আছে। ভালোই কাটিত সময়। কিন্তু মাঝে মাঝে বিপত্তি বাধিত। মেঘ কালো করিয়া, ধুলাবালি উড়াইয়া যখন বাতাস ছুটিত এবং এক সময় ঝমঝম করিয়া বৃষ্টি পড়িতে শুরু করিত তখন মনে হইত আকাশটা বুঝি এই বেলা আমার মাথার ওপর ভাঙিয়া পড়িবে। ছেলেমেয়েরা যে যাহার মত ছুটিয়া পালাইত। এত সব ছড়ানো ছিটানো জিনিসপত্তর গুছাইয়া ব্যাগে ভরিতে গিয়া যখন দেখিতাম মা হাতে বাঁশের কঞ্চি নিয়া প্রবল হুঙ্কারে উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম বিদীর্ণ করিয়া আমার দিকেই তাড়িয়া আসিতেছেন তখন আমি অসহায়ের মতন বসিয়া কাঁদিয়া ফেলিতাম। শব্দ হইত না। কোনো কোনো দিন চোখের জলে নাকের জলে আমার সকল কাঁদাকাটি বৃষ্টি আর কাদামাটির সহিত মিশিয়া একাকার হইয়া যাইত। কোনো দিন আবার কেবল দুয়েকটা ধমকানি খাইয়াই মাফ পাইয়া যাইতাম। কিন্তু তবুও মনে দুঃখ হইত এই ভাবিয়া যে, যাহাদের জন্য এতটা কষ্ট করিয়া আমি খেলিবার এত সব জোগাড়জন্ত করিলাম, সকল কিছু উজাড় করিয়া দিলাম যাহাদের, তাহারাই কিনা এমন বিপদের দিনে আমাকে একাকী ফেলিয়া চলিয়া গেল। একবারটি ফিরিয়াও দেখিল না আমি সব গুছাইতে পারিয়াছি, নাকি ঝড়ে-বাদলে, কাদায়-জলে মাখামাখি হইয়া মায়ের ভর্ৎসনা শুনিতেছি। শুধু যে বিপদের দিনেই এমন হইত তাহা নয়। অনেক সময় আমাদের খেলার চাইতেও বেশি আনন্দের আকর্ষণের কোনো কিছু পাড়ায় আসিয়া উপস্থিত হইলে সকলে আমাকে একলা ফেলিয়া উধাও হইয়া যাইত। এই যেমন সাপের খেলা দেখাইতে বেদেনিরা আসিলে, বাঁদরখেলা দেখাইতে বাঁদরওয়ালা আসিলে, এমনকি হাওয়াই মিঠাই, আইসক্রিম-চাটনি-গাট্টা, মিষ্টিআলু-চটপটি যাহাই আসুক না কেন সকলে হুড়মুড় করিয়া আমাকে ফেলিয়াই ছুটিয়া যাইত। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া কোনো রকমে সব খেলনাপাতি ব্যাগে ভরিয়া বাড়ি গিয়া মায়ের অনুমতি লইবার জন্য কাঁদকাঁদ চেহারা করিয়া কত যে অনুনয়-বিনয় করিতাম। অনুমতি পাইয়া যখন দৌড় দিতাম, পথে দেখিতাম ছেলেমেয়েরা সব হৈহৈ রৈরৈ করিয়া ফিরিয়া আসিতেছে। তাহাদের মুখে আমার প্রত্যক্ষ করিতে না-পারা ঘটনাবলির সত্যমিথ্যামিশ্রিত বিস্ময়কর গল্প শুনিতাম আর অবাক হইতাম, মনে মনে আফসোস করিতাম। আহা! কতো মজাই না তাহারা করিয়াছে। কত আনন্দই না তাহারা পাইয়াছে। আমি বরাবরের মতই বঞ্চিত হইলাম। এই বঞ্চিত হইবার চেয়েও যে দুঃখটা আমার মধ্যে একদিন বড় হইয়া উঠিল তাহা হইল—বিপদকালে সকলের পরিত্যক্ত হইয়া একাকী কালযাপন করা। যাহাদের সহিত এত আনন্দ এত উৎসবে মাতিয়া সংসার খেলায় মজিয়াছি, হউক তাহা মিছামিছির, হউক তাহা ক্ষণিকের, বিপদ আসিলে সকলে নিজের প্রাণ বাঁচাইতে ব্যস্ত হইয়া যাহার যাহার ঠিকানায় ফিরিয়া যায়, অলক্ষ্যে সরিয়া যায়—আজকের করোনা শৈশবের সেই সত্যকেই যেন নূতন করিয়া মনে করাইয়া দিল। প্রয়োজন ফুরাইয়া গেলে প্রিয়জন অপ্রিয় হইয়া যায়, স্বার্থ উদ্ধার হইয়া গেলে আপনার লোক পরের পক্ষে সাফাই গায়—এ সব কিছুই বইপত্রের পড়া হইয়া মগজে ঠাঁই পাইয়াছিল। কিন্তু দেশবিদেশের খবরাখবর হইতে জানিতে পাই, করোনা ভাইরাস সেই বইপত্রের পড়াকেই আজ বাস্তবে প্রয়োগ করাইয়া দেখাইতেছে। যাহার ওপর প্রয়োগ ঘটাইতে পারিতেছে না—সে মা।