একটা শেষ না হওয়া গল্পের গল্প

একটা শেষ না হওয়া গল্পের গল্প


পুবমুখী মাটির ঘর। ছনপাতায় ছাওয়া বারান্দা। বারান্দার এক কোণে শুকনো পেয়ারা গাছের খুঁটি, সাপের মতন বাঁকা। তাতে ঠেস দিয়ে খেজুর পাতার ছেড়া মাদুরে বসে তসবিহ্ হাতে ঝিমোয় সত্তর-আশি বছরের এক বৃদ্ধা। পিচুটি লাগা চোখের কোণে মাছির ভনভনানি। মাদুরের একপাশে ছোট্ট একটি বিছানা, তাতে তেলচিটচিটে ছোট্ট বালিশ, ছোট্ট কাঁথা। কাঁথায় ছড়ানো-ছিটানো নূতন চালের মুড়ি, দু’টো বাতাসা, একটা থেতলে যাওয়া পাকা কলা। পাশে উল্টানো বেতের ঝুড়ি।

মাটির মেঝে। প্রস্রাব করে কাদা করে ফেলেছে ছ’সাত মাসের একটি মেয়েশিশু। উদোম গা। নাকে-মুখে কাদা লেগে ভীষণ আদুরে দেখাচ্ছে যেন। উপুর হয়ে হামাগুড়ি দেবার চেষ্টা করছে কখনো; কখনো আবার মাড়ি দেখিয়ে অ-আ শব্দ করে হেসে উঠছে। কাদায় মাখামাখি শিশুটিকে দেখে ভীষণ মায়া লেগে যাবার আগে আপনার দৃষ্টি হয়তো সরে যাবে বাড়ির উঠোনের ও-পারে। দেখবেন, একটা বেটেগোছের মহিলা মাথায় নানান রকম জিনিসের পসরা নিয়ে হাঁক দিচ্ছে—“কই গো মা-খালারা, রাখবেননি কাছের গেলাস, বাসনকোসন, থালাবাটি…”।
পানের পিকটা ফেলে মহিলাটি হয়তো কাউকে জিজ্ঞেস করবে—“এ অ্যা ছ্যাড়া, তর মায় গ্যাছে কো? অ্যাট্টা লবণদানির কতা কইছিন, রাখবোনি”?

তখন উঠোনের এক কোণে সরে আসতে আসতে আপনি দেখতে পাবেন ছ’সাত বছরের একটা ছেলে বারান্দায় নারকেল গাছের গুড়ি দিয়ে বানানো সিঁড়িতে বসে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে একমনে মাটি খুঁড়ে যাচ্ছে। পাশে পড়ে আছে রিক্সার একটা বাতিল টায়ার, ভেতরে উল্টে গিয়ে কালো ভ্রমরগোছের একটা পোকা ভোঁ ভোঁ শব্দ করে উড়ে যাবার চেষ্টা করছে, পারছে না।

বেটে মহিলার প্রশ্নের জবাবে ছেলেটির উত্তর শুনে আপনি যখন বুঝতে পারবেন ছেলেটির মা তার বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে আবার নানুবাড়ি চলে গেছে, তখন দূরে শীতলক্ষ্যার চরে পানকৌড়িদের শেষ বিকেলের ডাক শোনা যাবে। আপনি তন্ময় হয়ে সেই ডাক শুনতে শুনতে পথে পা বাড়াবেন। তখন ছ’সাত বছরের ছেলেটি টায়ার দৌড়াতে দৌড়াতে আপনার আগে আগে চলে যেতে যেতে মিলিয়ে যাবে অনেক দূরে। আপনার পাশ দিয়ে হয়তো হেলেদুলে হেঁটে যাবে বেটেগোছের সেই মহিলাটি। হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর গেলে ছ’সাত মাসের সেই মেয়েশিশুটির কান্না শুনে আপনার তন্ময়তা ভেঙে যাবে হঠাৎ। তখন আবার চলতে শুরু করবেন এবং দেখতে পাবেন পথের ধারে তেঁতুল গাছের তলায় কাঁচা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা একটা নূতন কবর। কবর দেখে আপনার চোখে, আপনার চিন্তায়, আপনার চলনে গভীর তন্ময়তা ভর করবে আবার।

ছোট্ট মেয়েশিশুর ভীষণ মায়ালাগা ব্যথাতুর কান্না, ফেরিওয়ালির হাঁকাহাঁকি, দূরে লক্ষ্যার চরে পানকৌড়িদের ডাকাডাকি—সবকিছু মিলেমিশে একটা ধূসর শব্দের ধুম্রজাল যখন তৈরি হবে আপনার মস্তিষ্কে, তখন হয়তো আপনি বুঝে নিতে পারবেন—এ গল্পের কেবল লেখাটাই হলো শেষ; গল্পটা নয়।