আসার আশায়
ছাইয়ের দরে দেহদানের এই হলো ফল। বদ্ধ ঘরে সে দেহ পচে-গলে। দুয়ারে দাঁড়িয়ে একটিবার উঁকি দেবার কেউটি নেই। ও-ঘর থেকে সইরা বলে, “সে নাগর ভেগেছে বড়ো। যা লিবার তা লিয়েই তো গ্যাছে লা, আর কি ফেরে?” নিচতলার বারান্দায় লোহার খাঁচায় বন্দি বাড়িওয়ালির পোষা ময়নাটি তখন গলা চড়িয়ে বলে, “কাভি নেহি! কাভি নেহি”!
এসব কথায় বুক ধড়ফড় করে না তুশির। দরজার খটখট শব্দ শুনে আশায় বাঁধে বুক, চোখ হয় সন্ধ্যার সূর্যের মতো লাল; ‘এই সে এলো ব’লে’।
কিন্তু কেউ আসে না। চৌকাঠের নিচ দিয়ে একখানা ভাতের থালা ক্যাচক্যাচ্ শব্দ ক’রে মেঝে অবধি এসে থেমে যায়। ও-পাশ থেকে খুশু খালা পানের পিকটা গিলতে গিলতে বলে, “তোর রূপের আগুন ছুড়ি নিভে নাই লা। যম ব্যাটারে ভুলায়-ভালায়ে এ যাত্রা বাছতি পারিসনি দ্যাখ্”।
তুশির কানে যায় না এ সব কথা। জেগে দেখা স্বপ্নের ঘুম আসে দু’চোখ ভ’রে। ভাবে, ‘নিশ্চয়ই আসবে সে’। শরীরের প্রতিটা অঙ্গের প্রতিটা বিন্দু টিপে-টিপে কবিতার ছন্দ বের ক’রে আনা সে লোকটা; আধোয়া মুখে চুম্বনের দায়ে বুড়িগঙ্গার কালো জল দিয়ে সাড়ে সাতবার কুলকুচি করবার পরেও আঁচলের তলায় একটুখানি ঠাঁই পাবার আশায় বারবার ফিরে ফিরে আসা সেই খোঁচাদাড়ি, ঘনকালো গোঁফের মায়ালাগা মুখটা—নিশ্চয়ই আসবে।
সুখের দিনে যে আপনার মানুষ, দুঃখের দিনে সে না-এসে থাকতে পারে?
নিচতলার বারান্দায় বাড়িওয়ালির পোষা ময়নাটি আবার চেঁচিয়ে ওঠে, “কাভি নেহি! কাভি নেহি”!
সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়, সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত। গলির মোড়ে চায়ের দোকানগুলোতে হ্যাজাকের আলো। সে আলোয় কতো লোকের ভিড়। অডিও ক্যাসেটের ম্যাগনেটিক ফিতায় চলে অনন্ত যৌবনা-জীবনের তুমুল নৃত্য—‘লেকে প্যাহলা প্যাহলা পেয়ার ভারকে আঁখো ম্যা খুমার যাদু নাগরি সে আয়া হ্যায় কোয়ি যাদুগার’।
গীত-বাদ্য-নৃত্যের প্রতিধ্বনি পুরান ঢাকার প্রতিটা রংচটা বাড়ির দেয়ালে-দেয়ালে বাধা পেয়ে পেয়ে নূতন মুদ্রা-তাল-লয়-সুরের জন্ম দেয় প্রতি মুহূর্তে। কেবল তুশির ঘরে নৈঃশব্দের বীভৎস গর্জন।
কেরোসিনের কুপি নিভুনিভু প্রায়। মধ্যরাতে দরজা-জানলার খটখট শব্দে জেগে দেখা স্বপ্নের ঘোর কাটে তার। সজল চোখে প্রবল উৎসাহে পাশ ফিরে দ্যাখে আর জিজ্ঞেস করে, “কবি এলে এতক্ষণে”? জবাব দেয় না কেউ।
বসন্তের উন্মত্ত বাতাস জানলাগুলোকে আরো কয়েকবার নাড়িয়ে দিয়ে বুড়িগঙ্গার কালো জলে মিহিমিহি ঢেউ তোলে। কবির আসবার আশায় তুশি ক্লান্ত দু’চোখ বড়ো কষ্টে মৃদু খুলে রাখে আর বিড়বিড় ক’রে বলে, “সুখের দিনে যে প্রাণের পুরুষ, দুঃখের দিনে সে কি না-এসে থাকতে পারে”?
বসন্তের উন্মত্ত বাতাস শোঁ শোঁ গুঞ্জনে আবার স্বপ্নের ঘোর আনে ক্লান্ত-সজল চোখে। নিচতলার বারান্দায় লোহার খাঁচায় বন্দি বাড়িওয়ালির পোষা ময়নাটি তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ জেগে উঠে সে আর বলে না, “কাভি নেহি! কাভি নেহি”!