আমি আবার তোমার আঙুল ধরতে চাই
সকাল সাড়ে ছয়টা। পথে-ঘাটে মানুষজন খুব কম। ভার্সিটির বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। বাস আসে পৌনে সাতটায়। অথচ এই পনেরোটা মিনিট আমার কাছে মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকালের মতো সুদীর্ঘ-ব্যাপ্ত-বিস্তৃত। সময় কাটানোর জন্যে ফেসবুকে লগইন করলাম। দেখি প্রায় সকলেই ‘বাবা দিবস’ নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছে; ভালোবাসা জানিয়েছে বাবার প্রতি। কেউ কেউ দীর্ঘকাল ধরে বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখা সেই “বাবা তোমায় বড্ড ভালোবাসি” কথাটুকুন যেন বলে ফেলতে চেয়েছে এক নিঃশ্বাসে। আসলে সামনাসামনি ‘ভালোবাসি’ কথাটা বাবা-মাকে বলতে পারে না সবাই। তবুও যারা অন্তত ব্লগে, ফেসবুকে কিংবা কেবল মাত্র কাছের বন্ধুদের সঙ্গে কথাচ্ছলে হলেও বাবা-মায়ের প্রতি ভালোবাসার কথা, তাদের প্রতি পরম অনুভূতির কথা অকপটে ব্যক্ত করতে পারে; বোধ করি তারা স্বর্গীয় সুখের কোমল স্পর্শ এতটুকুনও কম পায় না।
আমি তাদের দলে নই। কেননা বাবা-মাকে যে আমি ভালোবাসি সে কথা কোনো দিন বলতে পারি নি, এখনও পারি না এবং কখনোই পারবো না। কেন পারবো না—আমি তা জানি না। শুধু জানি পৃথিবীর আর সব ছেলেদের মাথার ভেতরে যেরকম একটা মস্তিস্ক আছে, বুকের পাঁজরের নিচে যে রকম একটা হৃদপিণ্ড আছে; আমারও সেরকমটাই আছে। তারা মস্তিষ্ক দিয়ে তাদের বাবা-মাকে নিয়ে যা ভাবে, হৃদয় দিয়ে যা অনুভব করে, আমিও বোধয় তার ব্যতিক্রম কিছু করি না। কিন্তু তবুও সে কথাটি আমি কখনোই তাদের বলতে পারবো না।
আমি যখন বাসা থেকে বের হই তখন বাবা ঘুমে। এক সময়কার অতিকায় দেহটি আজ অথর্ব, নিথর, কঙ্কালসার হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। কথার তীব্রতায় বিরক্ত হয়ে মা যাঁকে ফাটা বাঁশ কি বাচাল বলে তিরস্কার করতেন, সে মানুষটি আজ মুখের সব কথা হারিয়ে অবুঝ ছোট্ট শিশুটির মতন কেমনটি হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন—অথচ আসার সময় তাঁর মৃতপ্রায় কালো দেহটা একটুখানি ছুঁয়ে দেখবার মতো সাহস আমার হলো না। কেন হলো না—আমি বলতে পারিনা।
পরপর কয়েক রাত নানা দুঃস্বপ্ন দেখার পর ভাবলাম বাড়ি থেকে একটু ঘুরে আসি। সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। বাড়ি গিয়ে আর ঢাকায় ফিরতে মন চাচ্ছিল না। ডাক্তার বলেছে বাবার সুস্থ হয়ে যাওয়াটাই অস্বাভাবিক। মস্তিষ্কের একটা শিরায় কতগুলো রক্তকণিকা শুকিয়ে গিয়ে রক্ত চলাচলে বাঁধার সৃষ্টি করছে। শুকিয়ে যাওয়া রক্তকণিকাগুলো সরিয়ে ফেলা সম্ভব নয়; অথবা অনেক ব্যয়বহুল। চিকিৎসা চলছে; বাকিটা সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে। আজকের দিনটাতে প্রার্থনা এই, ‘পৃথিবীর সব বাবারা সুস্থ থাকুক, সব বাবা-মায়েরা তাদের সন্তানদের নিয়ে সুখে থাকুক, সব সন্তানরা বাবা-মাকে ভালোবাসার কথাগুলো নির্দ্বিধায় বলতে পারুক’। আর আমার বাবা সুস্থ হয়ে আবার আমার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করুক কিংবা আড়ালে দাঁড়িয়ে আমার গান শুনুক।
বাস থেকে নেমে টিএসসিতে বসে ছিলাম কিছুক্ষণ। আমার পাশে বসে এক বড় ভাই মোবাইলে গান শুনছিলেন, ‘চলো পাল্টাই’ মুভির গান। বাবার আঙুল ধরে হেঁটেছি এমন স্মৃতি আমার মনে পড়ে না। তবুও আজ কেন জানি বড্ড ইচ্ছে করছে সেই ছোট্টটি হয়ে বাবার আঙুল ধরে হেঁটে যাই কাঁচা সবুজ ধান ক্ষেতের পাশ দিয়ে, সকালের শিশির মাখা সজীব ঘাসের উপর দিয়ে; কিংবা প্রখর রোদে টুকরো টুকরো মেঘের ছায়া পড়া বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্য দিয়ে কোনোখানে, যেখানে আকাশ আর মাটি এক হয়ে গিয়ে মিশেছে কোথায় যেন। কী জানি কি সংকোচে গানটা চেয়ে নিয়ে আসতে পারিনি। দু’টো লাইন মনে রেখেছি শুধু। বড়ো অদ্ভুত সুন্দর কথা গুলো, বড়ো মিষ্টি সুর সে গানের।
“বাড়িয়ে দাও তোমার হাত, আমি আবার তোমার আঙুল ধরতে চাই
বাড়িয়ে দাও তোমার হাত, আমি আবার তোমার পাশেই হাঁটতে চাই
বাড়িয়ে দাও তোমার হাত, তোমার হাত”।