আত্মোন্মোচন

আত্মোন্মোচন


ভালোবাসায় মানুষ অন্ধ। ভালোবাসতে, ভালোবাসা পেতে মানুষ অন্ধ। ভালোবাসার জন্য মানুষ কী-ই না করতে পারে! সম্পর্কটা যা-ই হোক না কেন, ভালোবাসাটা যখন নিঃস্বার্থ আর হৃদয়-নিংড়ানো হয়; ভালোবাসায় তখন ভালো ছাড়া মন্দের খোঁজ পাওয়া যায় না এক তিল। এমন ভালোবাসার জোরেই মানুষ বুকে হাত রেখে বলতে পারে, “জীবন দিয়ে দিতে পারি!”
কিন্তু মজার ব্যাপার কী জানেন, মানুষ নিজের জন্য ছাড়া কারো জন্যই জীবন দিতে প্রস্তুত নয়, কারো জন্যই জীবন দিতে ইচ্ছে পোষণ করে না; স্বপ্নেও ভাবে না জীবন দেবার কথা। কেবল নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্যই মানুষ জীবন দিতে পারে—কেন জানেন? আরেকটা কঠিন প্রশ্ন করলে উত্তরটা সহজ হয়। আচ্ছা বলুন তো, কাকে আপনি সব চেয়ে বেশি ভালোবাসেন?
মা? বাবা? ভাই-বোন? অথবা রক্তের সম্পর্কের বাইরে বিপরীত লিঙ্গের কেউ একজন?
যে কেউ-ই হতে পারে। কিন্তু আমি বলবো, আপনি যাকে সব চেয়ে বেশি ভালোবাসেন—সে আপনি নিজে; আর কেউ নয়, এমন কি সৃষ্টিকর্তাও না।

এ-নিছক আমার ভাবনা; সত্যই হবে এমন নয়। তারপরেও আপনি হিশেবটা একটু মিলিয়ে নিতে পারেন। আপনার কাছে প্রিয়তায় আপনিই সবার চেয়ে এগিয়ে—এ-সত্য যদি ঠিকঠাক বুঝে নিতে পারেন তাহলে এ-ও জেনে রাখবেন, প্রতিদিন যে-চোখটা, নাকটা, মুখটা—যে-গোটা মানুষটাকে বড়ো আদুরে-আলতো দৃষ্টিতে আপনি নিয়ম ক’রে আয়নায় দ্যাখেন, তার বৃহত্তম মন্দটাও ক্ষুদ্রতম ভালোর ছায়াটিকে মাড়িয়ে আপনার নজরে আসতে পারে না; কেননা, ভালোবাসায় মানুষ অন্ধ। আপনি অন্ধভাবে আপনাকে ভালোবাসেন।

অন্ধ-ভালোবাসায় পূণ্যি আছে কিনা জানিনে, তবে পাপ নেই—এটুকুন আশ্বাস আপনাকে দিতে পারি। তারপরেও কী জানেন, ভোগান্তি আছে ঢের। আবেগের বাড়াবাড়িতে যুক্তির খুঁটিগুলো ভেঙে যায় ব’লেই ভালোবাসা অন্ধ হয়। অন্ধ ভালোবাসা বাস্তবতার সামনে সুস্থভাবে দাঁড়াতে পারে না কখনো; পুড়ে যায়। থাকে কেবল ভালোবাসার কঙ্কাল।

আপনি আপনাকে অন্ধভাবে ভালোবাসেন ব’লে আপনার হাজারটা দোষ হাজারটা মন্দ দিক আপনার চোখ ফাঁকি দিয়ে যায়, ধরা পড়ে না; ধরা পড়ে অন্যের চোখে। ভাবনায় নিজেকে ভাবতে লাগে সকলের চেয়ে যথার্থ, আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগে অনেকের চেয়ে সু-শ্রী। নিজের প্রতি নিজের এমন অন্ধ ভালোবাসা থাকাটা এক রকমের ব্যধি মনে হয় আমার কাছে। এ-ব্যধি থেকে মুক্তির উপায় কী জানেন? আমি অবশ্য একটা পথ্যি খুঁজে বের করেছি। আমার জন্য। আপনি বন্ধু ব’লে আপনাকে বলছি। পথ্যিটা হ’লো—নিজেকে খুঁজে বের করা। নিজেকে নিজের ভেতর আবিষ্কার করা। অর্থাৎ ছোটো-মতো একটা সাধনা আর কী। নিজেকে চেনবার এই সাধনায় একবারটি সিদ্ধি লাভ করতে পারলে না সকল বিকারগ্রস্ত আত্ম-প্রিয়তা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে বোধয়। তখন নিজেকে আর নিজের চোখে দেখা হবে না। নিজেকে দেখা যাবে পরের চোখে, নামপুরুষের দৃষ্টিকোণে। সহজ কথায় অন্যরা আমায় যেভাবে দ্যাখে, আমিও আমায় ঠিক সেভাবে দেখতে পাবো। আমার চোখে আমার দোষ-গুণগুলো সমান্তরাল অবস্থান করবে। তখন হবে কী, দোষের সকল ফাঁকগুলি গুণের প্রলেপে ঢেকে দিতে পারবো চিরকালের মতন। তারপর পরিমিত আবেগের যৌক্তিক ভালোবাসায় আমার একটা আদর্শ আমিকে নিয়ে দুরূহ বাস্তবতার সামনে বলিষ্ঠভাবে দাঁড়াতে পারবো আমি—এ-বিশ্বাসটুকুন আমার এতোকালের অর্জন। আপনি বন্ধু ব’লে আপনাকেই বললাম। আসুন আমরা আত্মোন্মোচনের সাধনা করি।