অসুখে স্মৃতিচারণ : বইপড়ানো মাস্টারদের পাল এবং মহামান্য নয়া পাগলা
ছোটো বেলায় আমি যখন বড়ো হচ্ছিলাম তখন হতে পড়া আর লেখা আর পরীক্ষা-টরিক্ষা কিছুমিছু আমার ভাল্ লাগে না, তাই জন্যে মাঝেসাঝে আমি লক্ষ্যার পাড়ে যেয়ে বসে বসে থাকি আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকি শুধু। আমি তো ভালো ছাত্র আর ভালো ছেলে, মাস্টাররা বলে, তাই কলেজে যাওয়া আমি বন্ধ করি না, একদিনও না। কিন্তু মাস্টারদের বইপড়া বকবক আমার ভাল্ লাগে না, তাই জন্যে মাঝেসাঝে আমি লক্ষ্যার পাড়ে যেয়ে বসে বসে থাকি আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকি শুধু। যেদিন আরিফ-এনাম, শামীম-ওমররা দলবেঁধে কলেজে আসে না, আমি সাইকেল নিয়ে কখনও বানিয়াদি ব্রিজের দিকে, কখনও লাখপুরে শীতলক্ষ্যার দিকে ছুটি। লক্ষ্যার অই পাড়ে রানীগঞ্জ। অইখানে আমার বাপের বাড়ি। কিন্তু অইখানে যাওয়া আমার বারণ, তাই জন্যে মাঝেসাঝে আমি লক্ষ্যার পাড়ে যেয়ে বসে বসে থাকি আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকি শুধু। গাঙের মাঝখানে একটা চর, নাম হলো মাঝের চর, রানীগঞ্জ থেকে দক্ষিণে প্রায় তিন কিলোমিটার, একেবারে তারাগঞ্জ পর্যন্ত বড়ো। কী যে সুন্দর আর সবুজ আর নির্জন। অইখানে সব সময় যাওয়া যায় না, নিষেধ। আমি তাই ঘাটের কাছে বড়ো টিলাটায় যেয়ে একটা বড়ো গাছের নিচে একটা সুপারিখোলের মাচার ওপর বসি, জায়গা না পেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকি শুধু। নয়া পাগলা তখন দোতরায় টুংটাং করে লালনের গান গায় আর বলে, “পুরান পাগলার ভাত নাই, নয়া পাগলার আমদানি”, আর চুলের জটা নাড়িয়ে নাড়িয়ে গান করে।
“অনাসে দেখতে পাবি কোনখানে সাঁইর বারামখানা,
আপন ঘরের খবর লে না”।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে আমার ঘুম পায়। মাস্টাররা “Know Thyself” শেখানোর জন্য আমাকে দুই হাজার চার’শ ষোলো বছর আগেকার গ্রিসের কোনো একটা আশ্রমে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু গ্রিস আমি চিনি না, আমার ভাল্ লাগে না, তাই জন্যে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মাঝেসাঝে আমি লক্ষ্যার পাড়ে যেয়ে বসে বসে থাকি আর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকি শুধু। আমি ভাবি, নয়া পাগলাকে মাস্টার বানানোর জন্যে সরকারের কাছে একটা চিঠি লিখবো একদিন আরও অনেক বড়ো হয়ে। অই তো, পাগলা গান ধরেছে আবার। শোনবার খুব ইচ্ছে আমার। কিন্তু আমার চোখে তো আগুন। আমি তো আর ঘুমাতে পারি না। আমায় একটু ঘুম পাড়িয়ে দিন না, মাথায় একটু বিলি বিলি কেটে, একটু কেমন আদর আদর করে। পাগলা এখন বোধয় এই গানটা ধরেছে, না?
“আপনারে আপনি চিনে নে,
দিন-দোনের পর যার নাম অধর
তারে চিনবো কেমনে”।